বাংলা নাট্য সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান (১৮৩০-১৮৭৩)
বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্র এক ইতিহাস সৃষ্টিকারী নাটককার। তাঁর জন্ম ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে, নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়ায়। প্রকৃত নাম ছিল গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র । ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘দীনবন্ধু’ নাম গ্রহণ করেন। পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রায় বাহাদুর উপাধিলাভ করেন।
বাংলা নাট্য সাহিত্যে মধুসূদনের পর দীনবন্ধু মিত্রের আবির্ভাব। মাইকেল মধুসূদনের সৃষ্টিতে যে নাটকের সার্থক প্রকাশ ঘটে দীনবন্ধু তাকে আরো পূর্ণ ও বিকশিত করে তোলেন। তিনি মাইকেল-যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার তো অবশ্যই, আধুনিক কালেও তাঁর মর্যাদা ও মহিমা কোথাও কমেনি। বিশেষত ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি যে প্রতিবাদী জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন আজও তা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত। সমসাময়িক সামাজিক জীবনের উজ্জ্বল আলেখ্য হিসাবে তার নাটকগুলির স্বতন্ত্র মর্যাদা রয়েছে।
দীনবন্ধু মিত্রের নাটক ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :
দীনবন্ধু মিত্র চারটি পূর্ণাঙ্গ নাটক ও তিনটি প্রহসন রচনা করেন। এছাড়াও একটি অপ্রকাশিত ক্ষুদ্র নাটিকাও তিনি লিখেছিলেন।
১. নীলদর্পণ (১৮৬০)
বিষয়ঃ বাংলায় নীলচাষীদের উপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার ও তার কুফল।
অঙ্ক সংখ্যা- ৫টি।
চরিত্রগুলি হল – গোলোক বসু, নবীনমাধব, সাবিত্রী, সৈরিন্ধ্রী, ক্ষেত্রমণি, সাধুচরণ, তোরাপ, আদুরি রায় চরণ, পি পি রোগ।
উৎসর্গ – ভুমিকায় লেখা ছিল ” নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অর্পণ করিলাম।”
নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ৭ই ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয়।
দীনবন্ধুর সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় নাটক।
‘Nil Darpan, or The Indigo Planting Mirror ‘ এই নামে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকের অনুবাদ করেছেন। এটিই প্রথম বাংলা নাটক যা ইংরেজিতে অনূদিত হয়।
২. নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩)
অঙ্ক সংখ্যাঃ ৫ টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ রমণীমোহন, জলধর, বিনায়ক, মাধব, মালতী, মল্লিক্ জগদম্বা ।
উৎসর্গঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে।
নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি প্রথম অভিনীত হয়।
৩. বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬)
মধুসুদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ অনুকরণে রচিত।
বিষয়ঃ একটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে রচিত হাস্যরসাত্মক প্রহসন।
অঙ্ক সংখ্যাঃ ২টি।
প্রধাণ চরিত্রঃ নসিরাম, রাজীবলোচন, রামমণি, ভূবনমোহন ।
উৎসর্গ – শারদাপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়কে।
৪. সধবার একাদশী (১৮৬৬) প্রহসন
মধুসূদনের ‘একেই কী বলে সভ্যতা’-র অনুকরণে রচিত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রহসন।
বিষয়ঃ পাশ্চাত্য প্রভাবপুষ্ট নবীন যুব সম্প্রদায়ের অনাচার ও তার প্রতিকারের ভাবনা নিয়ে প্রহসনটি রচিত।
অঙ্ক সংখ্যাঃ ৩টি।
মূল চরিত্রঃ অটলবিহারী, গোকুলচন্দ্র, সৌদামিনী, নিমচাঁদ, কুমুদিনী, নকুলেশ্বর।
নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর প্রথমবার অভিনীত হয়।
৫. লীলাবতী (১৮৬৭)
বিষয়ঃ কোলকাতার শহরতলী নিয়ে লেখা রোমান্টিক হাস্যরস নির্ভর প্রহসন।
অঙ্ক সংখ্যাঃ ৫টি।
প্রধান চরিত্রঃ হরবিলাস, অরবিন্দ, শ্রীনাথ, লীলাবতী, ক্ষীরোদবাসিনী, রাজলক্ষ্মী, লোলিত, মোহন ।
উৎসর্গঃ গুরুচরণ দাসকে।
৬. জামাইবারিক (১৮৭২)
বিষয়ঃ ধনী সমাজে ঘর জামাই রাখার প্রবণতার মধ্যে যে নির্লজ্জতা ও স্বার্থপরতা এবং নিষ্ক্রিয় মানসিকতার অসুস্থতা বিদ্যমান তা হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করা হয়েছে।
প্রধান চরিত্রঃ বিজয় বল্লভ, অভয়কুমার, পদ্মলোচন, কামিনী, বিন্দুবাসিনী।
অঙ্ক সংখ্যাঃ ৪টি।
উৎসর্গঃ নাটকটি উৎসর্গ করা হয় রাসবিহারী বসুকে।
নাটকটি ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয়।
৭. ‘কমলে কামিনী’ নাটক (১৮৭৩)
দীনবন্ধু মিত্রের শেষ নাটক ।
অঙ্ক সংখ্যাঃ ৫টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ রাজা, বীরভূষণ, সমরকেতু, গান্ধারী, সুশীলা, সুরবালা । সুরবালা চরিত্রে বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের বিমলা চরিত্রের প্রভাব দেখা যায়।
উৎসর্গ করেছেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরকে।
৮. কুড়ে গোরুর ভিন্ন গোঠ ( অপ্রকাশিত)
ক্ষুদ্র নাটিকা।
দৃশ্যঃ ২ টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রঃ ভোদা, গোমা, স্বার্থক, বলদ ।
দীনবন্ধু মিত্রের নাটকের বৈশিষ্ট্য :
দীনবন্ধু বাংলা সাহিত্যের বাস্তবতার অগ্রদূত এবং তিনি বোধহয় বাংলা সাহিত্যের প্রথম প্রধান বাস্তববাদী লেখক। তখনকার মত এখনো বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে দীনবন্ধুর নীলদর্পণ ও সধবার একাদশী অভিনীত হয়। বিশেষ করে নীলদর্পণের নাট্যকার হিসাবে তার খ্যাতি চূড়ান্ত। দীনবন্ধুর শিল্পে মানুষের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য তার বস্তু চেতনা, এই বস্তুচেতনার উৎস কিন্তু পুথির জগত বা চিন্তার জগৎ নয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজাত। সব ধরণের নাট্য সৃষ্টিতে দীনবন্ধু সফল ট্রাজেডিটি কমেডি প্রহসন প্রতিটি সৃজনরূপেই দীনবন্ধুর প্রতিভা দীপ্ত।
উচ্চশ্রেণির চরিত্রে দীনবন্ধু সফল না হলেও সাধারণ অতি সামান্য চরিত্রের অঙ্কনে তিনি অত্যন্ত সফল, তার তোরাপ, আদুরী ইত্যাদি বাংলা সাহিত্যে অতুলনীয়। দীনবন্ধুর নাট্যরচনায় প্রেরণা দান করেছে বাঙালির শাশ্বত জীবনবোধ ও সমকালের বিক্ষুদ্ধ গণজীবন। সমসাময়িক বিক্ষুব্ধ গণজীবনের সঙ্গে একতা অনুভব করেছিলেন বলেই “নির্যাতিত জীবনের সহানুভূতিশীল বাণীকার” রূপে তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
Important SAQ question :
1) দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম সাল কত ?
উঃ ১৮৩০
2) দীনবন্ধু মিত্রের নবীন তপস্বিনী নাটকটি কাকে উৎসর্গ করেন ?
উঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
3) নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদের নাম কী ? কার নামে প্রকাশিত হয় ? প্রকাশকের কী শাস্তি হয়েছিল ?
উঃ ‘‘Nil Darpan, or The Indigo Planting Mirror ‘’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনূবাদ করলেও পাদ্রী লঙ সাহেবের নামে প্রকাশিত হয়। লঙ সাহেবের ১ মাসের কারাদণ্ড ও ১০০০ টাকা জরিমানা হয়। আদালতের জরিমানার টাকা দেন কালিপ্রসন্ন সিংহ ।
4) নীলদর্পণ নাটকটি কোথায় কবে প্রথম অভিনয় হয় ?
উঃ ন্যাশনাল থিয়েটারে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ৭ই ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয়।
5) নিমচাঁদ দীনবন্ধু মিত্রের কোন নাটকের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র ?
উঃ সধবার একাদশী ।
6) নীলদর্পণ নাটকটি কাকে উৎসর্গ করেন ?
উঃ ভুমিকায় উৎসর্গ স্থলে লেখা ছিল “নীলকরনিকরকরে নীল-দর্পণ অর্পণ করিলাম।”
7) মধুসূদনের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ অনুকরণে দীনবন্ধু মিত্র কোন নাটকটি রচনা করেছেন ?
উঃ ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো।’
8) ‘সধবার একাদশী’’ নাটকে মোট কটি অঙ্ক রয়েছে ?
উঃ ৩টি ।
9) ‘কমলে কামিনী নাটক’ এর প্রকাশকাল কত ?
উঃ ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ ।
10) জামাই বারিক নাটকটি কাকে উৎসর্গ করেন ?
উঃ রাসবিহারী বসুকে ।
11) দীনবন্ধু মিত্রের দুটি গদ্য স্কেচ জাতীয় রচনার নাম কী ?
উঃ ‘পোড়া মহেশ্বর’ ও ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’।
12) দীনবন্ধু মিত্রের কাব্য-কবিতাগুলির নাম কী ?
উঃ দীনবন্ধু মিত্রের কাব্য-কবিতাগুলির নাম হল- ‘সুরধনী কাব্য’ , ‘দ্বাদশ কবিতা’ ও ‘নানা কবিতা’ ।