নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক নবজাগরণে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম। তিনি বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষের পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছেন । বাংলা সাহিত্যে
এমন একটি ধারা নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া নেই । বাংলা নাট্য সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথের অবদান বিশ্বজনীন। আজ আমরা নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের অবদান সম্পর্কে জানবো।
রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করা যায় –
ক) গীতিনাট্য – ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১), ‘কালমৃগয়া'(১৮৮২), ‘মায়ার খেলা’ (১৮৮৮) ইত্যাদি।
খ) কাব্যনাট্য – ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ'(১৮৮৪), ‘রাজা ও রাণী'(১৮৮৯), ‘বিসর্জন'(১৮৯০),
‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৮৯২) ইত্যাদি ।
গ) নাট্যকাব্য – ‘বিদায় অভিশাপ’ (১৮৯২), ‘গান্ধারীর আবেদন’ (১৯০০), ‘সতী’ (১৯০০),
‘নরকবাস'(১৯০০), ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ (১৯০০) ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’ (১৯০০) ইত্যাদি ।
ঘ) প্রহসন – ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৯২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭), ‘ব্যঙ্গকৌতুক (১৯০৭),
‘চিরকুমার সভা’ (১৯৩৬) ইত্যাদি ।
ঙ) রূপক-সাংকেতিক নাটক – ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), ‘অচলায়তন’ (১৯১২), ‘ডাকঘর’(১৯১২), ‘ফাল্গুনী’ (১৯১৬), ‘মুক্তধারা’ (১৯২২), ‘রাজা’ (১৯১০) ‘রক্তকরবী’ (রচনা ১৯২৪ , প্রকাশ-১৯২৬), ‘কালের যাত্রা’ (১৯৩২) ইত্যাদি ।
চ) সামাজিক নাটক – ‘শোধবোধ'(১৯২৬), ‘বাঁশরী'(১৯৩৩) ইত্যাদি ।
ছ) নৃত্যনাট্য – ‘নটীর পূজা'(১৯২৬), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৮), ‘শ্যামা’ (১৯৩৯) ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাটক ও সেগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয়
১. রুদ্রচন্ড (১৮৮১)
লেখকের প্রথম নাটক।
বিষয় – হস্তিনাপুরের রাজা পৃথ্বীরাজের সঙ্গে রুদ্রচন্ডের দ্বন্দ্ব, রুদ্রচন্ডের পিতৃসত্তা,
মহম্মদ ঘোরী কর্তৃক হস্তিনাপুর অধিকার ও পৃথ্বীরাজের পরাজয়।
সর্গ সংখ্যা ১৪টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল পৃথ্বীরাজ, রুদ্রচন্ড, অমিয়া।
উৎসর্গ – জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
২. বাল্মীকিপ্রতিভা (১৮৮১)
গীতিনাট্য।
বিষয় – দস্যু রত্নাকরের বাল্মীকি হয়ে ওঠার কাহিনি।
দৃশ্য সংখ্যা – ৬টি।
নাটকের অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথ বাল্মীকি এবং তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা দেবী সরস্বতীর ভূমিকা
গ্রহণ করেছিলেন। এই নাটক অবলম্বনে পরবর্তীতে রচিত হয় ‘মায়ার খেলা’।
৩. রাজা ও রানী (১৮৮৯)
কাব্যধর্মী এবং নিয়মানুগ নাটক।
মোট অঙ্ক সংখ্যা ৫টি।
প্রধান চরিত্রগুলি হল বিক্রমদেব, সুমিত্রা, দেবদত্ত, কুমার, রেবতী, ইলা প্রমুখ।
উৎসর্গ – দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
এই নাটকের কাহিনি নিয়েই কবি পরবর্তীকালে লিখেছিলেন ‘ভৈরবের বলি’।
কিন্তু তা কবির পছন্দ না হওয়ায় প্রকাশিত হয়নি। আরো পরে এই নাটকের মূল বিষয় অবলম্বনে ‘তপতী’ নাটকটি রচনা করেন।
৪. বিসর্জন (১৮৯০)
ট্র্যাজেডি।
কবির ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের প্রথমাংশ নিয়ে রচিত।
অঙ্ক সংখ্যা ৫টি।
প্রধান চরিত্রগুলি হল গোবিন্দমাণিক্য, অপর্ণা, রঘুপতি, জয়সিংহ।
উৎসর্গ – সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে
৫. গোড়ায় গলদ (১৮৯২)
কৌতুকনাট্য
অঙ্ক সংখ্যা ৫টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল চন্দ্রকান্ত, নলিনাক্ষ, ইন্দুমতী, ক্ষান্তমণি।
এই নাটকেই কবি প্রথম বাউল গানের ব্যবহার করেন।
উৎসর্গ – প্রিয়নাথ সেনকে
গ্রন্থটি পরবর্তীকালে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ৪ অঙ্কে ‘শেষরক্ষা’ নামে প্রকাশিত হয়।
৬. প্রায়শ্চিত্ত (১৯০৭)
লেখকের ‘বউ ঠাকুরাণীর হাট’ উপন্যাসের কাহিনি অবলম্বনে রচিত।
মোট অঙ্ক সংখ্যা ৫টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল প্রতাপাদিত্য, বসন্ত রায়, ধনঞ্জয়, সুরমা, বিভা ।
নাটকটি পরবর্তীকালে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ অঙ্কে ‘পরিত্রাণ’ নামে মুদ্রিত হয়। তার আগে ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে শারদীয়া বসুমতীতে ‘পরিত্রাণ’ মুদ্রিত হয়েছিল ।
৭. শারদোৎসব (১৯০৮)
রূপক সাংকেতিক নাটক।
নাটকটি বোলপুরে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শারদোৎসব উপলক্ষ্যে ছাত্রদের দ্বারা অভিনয়ের উদ্দেশ্যে রচিত।
দৃশ্য সংখ্যা ২টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল ঠাকুরদা, উপনন্দ, লক্ষেশ্বর প্রমুখ।
পরবর্তীকালে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে এই নাটকটি সামান্য পরিবর্তন করে ‘ঋণশোধ’ নামে অন্য একটি নাটক প্রকাশ করেন কবি ।
৮. রাজা (১৯১০)
রূপক সাংকেতিক নাটক।
দৃশ্য সংখ্যা ২০টি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল সুদর্শনা, সুরঙ্গমা, রাজা, ঠাকুরদা।
পরবর্তীকালে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ‘অরূপরতন’ নামে এই নাটকের অভিনয় উপযোগী একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
৯. মুক্তধারা (১৯২২)
রূপক সাংকেতিক নাটক।
প্রকাশ – ১৩২৯ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়।
নাটকের পূর্বনাম ছিল ‘পথ’।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল অভিজিৎ, সঞ্জয়, অম্বা।
১০. ডাকঘর (১৯১২)
রূপক সাংকেতিক নাটক।
মুখ্য চরিত্র অমল, সুধা, মাধব।
১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে নাটকটি ইংরেজিতে ‘দ্য পোষ্ট অফিস’ নামে অনুবাদ করেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায় যার ভূমিকা লিখেছিলেন বিশিষ্ট ইংরেজ কবি ইয়েটস।
১১. কালের যাত্রা (১৯৩২)
রূপক সাংকেতিক নাটক।
প্রধাণ চরিত্র গুলি হলো -সন্ন্যাসী, প্রথম , দ্বিতীয় , তৃতীয় নাগরিক, সেনা ।
গ্রন্থটিতে দুটি নাটক আছে –‘রথের রশি’ ও ‘কবির দীক্ষা’।
১৩৩০ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ‘প্রবাসী’তে কবির ‘রথযাত্রা’ নামে যে নাটিকা প্রকাশিত হয় তাই-ই পরিবর্তিত রূপে ‘রথের রশি’ নামে প্রকাশ পায়। ‘কালের যাত্রা’ কবি সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রকে তাঁর ৫৭তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে উৎসর্গ করেছিলেন।
১২. রক্তকরবী (১৯২৬)
রূপক সাংকেতিক নাটক।
প্রকাশ – ১৩৩১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়।
নাটকটির পূর্বনাম, প্রথমে ‘যক্ষপুরী’, পরে পাণ্ডুলিপিতে তা পরিবর্তন করে নতুন নাম হয় ‘নন্দিনী’।
আরও পরে ‘প্রবাসী’তে প্রকাশের সময়কালে নাম পুনরায় পরিবর্তন করে এই নামটি গৃহীত হয়।
উল্লেখযোগ্য চরিত্র – নন্দিনী, বিশু পাগল, রাজা।
১৩. তাসের দেশ (১৯৩৩)
রূপকের আশ্রয়ে রচিত নাটক।
দৃশ্য সংখ্যা ৪টি।
নাটকটির প্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৩৪০ বঙ্গাব্দে কলকাতার ম্যাডান থিয়েটারে।
প্রধাণ চরিত্র গুলি হলো – রাজা, রানী,রাজপুত্র, সওদাগর ,পত্রলেখা।
উৎসর্গ – নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুকে।
১৪. নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা (১৯৩৮)
নৃত্যনাট্য।
প্রধাণ চরিত্র গুলি হলো- চণ্ডালিকা, আনন্দ ,দইওয়ালা, প্রকৃতি, চুরিওয়ালা, মায়া।
রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘নেপালী বৌদ্ধ সাহিত্যে শার্দুলকর্ণাবদানের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ অবলম্বনে লেখা।
নাটকে মণিপুরি ও কথাকলি নৃত্যশৈলীর ব্যবহার করা হয়েছে।
দৃশ্য সংখ্যা ২টি।
নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে ‘ছায়া’ রঙ্গমঞ্চে’।
১৫. শ্যামা (১৯৩৯)
নৃত্যনাট্য।
নাটকটি কবির ‘কথা’ কাব্যের ‘পরিশোধ’ কবিতা অবলম্বনে রচিত।
নাটকের আখ্যানভাগ গ্রহণ করা হয়েছে বৌদ্ধ পুরাণ ‘মহাবত্ত্ববদান’ থেকে।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল শ্যামা, বজ্রসেন।
রবীন্দ্রনাথের নাটকের মূল বৈশিষ্ট্য :
১) রবীন্দ্রনাথ ছিলেন মূলত কবি। সেইজন্যে তাঁর গল্প, উপন্যাস যেমন কাব্যধর্মী হয়েছিল, তাঁর নাটকগুলিও কাব্যাশ্রয়ে গঠিত হয়েছিল।
২) রবীন্দ্রনাথের নাটকে ঘটনার ঘনঘটা নেই। তার নাটকে ঘটনার আবর্ত যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা জীবনের দ্বন্দ্ব সংঘাত তেমন নেই। তাঁর নাটক গীতোচ্ছ্বাসময়, গীতি কবিতার আবেগে রঞ্জিত।
৩) যা দৃশ্য তাকে নাটকের বিষয়বস্তু না করে, বাস্তবকে পরিস্ফুট না করে তিনি কোন একটা ভাবকে রূপক রহস্যের সাহায্যে নাট্যরূপ দিতে চেয়েছিলেন। রবীন্দ্র নাট্য সাহিত্যে তাই দৃশ্যমানতা অর্থাৎ দৃশ্যত্ব লক্ষণ অপেক্ষা কাব্য লক্ষণই অধিকতর পরিস্ফুট।
৪) নাটকে থাকে ঘটনার দ্বন্দ্ব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটকে বহির্ঘটনার দ্বন্দ্ব নেই। চরিত্রের সংঘাত নেই, আছে কোন একটি তত্ত্ব বা Idea-র অভিব্যক্তি। এটা তার নাটকের বিশিষ্ট লক্ষণ।
৫) ঘটনার উপর ততটা দৃষ্টি না দিয়ে চরিত্রগত সূক্ষ্ম ভাব রহস্যকে রূপদান করেছেন। নাটকে ভাবের দ্বন্দ্ব-সংঘাত প্রদর্শন রবীন্দ্রনাথের মূল লক্ষ্য ছিল।
Important SAQ question :
1) রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার খেলা’ কী ধরনের নাটক ?
উঃ গীতিনাট্য ।
2) রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাজা ও রানী’ নাটকটি কাকে উৎসর্গ করেন?
উঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
3) রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন নাটকে প্রথম বাউলগানের ব্যবহার করেন ?
উঃ-গোড়ায় গলদ(১৮৯২)।
4) ‘শোধবোধ’ রবীন্দ্রনাথের কোন ছোটগল্পের নাট্যরুপ ?
উঃ কর্মফল ।
5) রবীন্দ্রনাথ তাঁর কোন নাটকটি কাজী নজরুল ইসলাম কে উৎসর্গ করেন ?
উঃ বসন্ত (১৯২২)।
6) ‘শেষের রাত্রি’ অবলম্বনে লেখা রবীন্দ্রনাথের নাটকটির নাম কী ?
উঃ গৃহপ্রবেশ ( ১৯২৫)।
7) মুক্তধারা নাটকের পূর্ব নাম কী ছিল ?
উঃ পথ ।
8) রবীন্দ্রনাথের দুটি নৃত্যনাটের নাম লেখো।
উঃ চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা ।
9) ‘রক্তকরবী’ প্রকাশকাল লেখো।
উঃ ১৯২৬ খ্রি.।
10) রবীন্দ্রনাথের দুটি রূপক সাংকেতিক নাটকের নাম লেখো ?
উঃ ডাকঘর, কালের যাত্রা।
11) রবীন্দ্রনাথের ‘কথা’ কাব্যের ‘পরিশোধ’ কবিতা অবলম্বনে রচিত নাটকের নাম কী ?
উঃ শ্যামা (১৯৩৯)।
12) রবীন্দ্রনাথের দুটি নাটকের নাম লেখ যেখানে কোনো অঙ্ক বা দৃশ্য বিভাজন নেই ?
উঃ বসন্ত, শাপমোচন।