বাংলা ব্যাকরণ। অব্যয় পদ কাকে বলে। শ্রেণিবিভাগ সহ আলোচনা
অব্যয় পদ কাকে বলে ?
যে সকল পদ বাক্যে ব্যবহৃত হলেও লিঙ্গ, বচন,পুরুষ, ক্রিয়ার কাল বা বিভক্তিভেদে ব্যয় বা পরবর্তিত হয় না, অর্থাৎ যাদের মূল রূপের পরিবর্তন হয় না, তাদের বলা হয় অব্যয় পদ । যেমন- এবং, কিন্তু, সুতরাং, বরং, ,অথবা, বিনা, তবে, নচেৎ, নতুবা, তথাপি, আর, ইত্যাদি।
যেমন: লোকটি গরিব কিন্তু সৎ।
*মনে রেখো – বাংলায় অব্যয় পদ তিনটি উৎস থেকে এসেছে। বাংলার নিজস্ব অব্যয় পদ, সংস্কৃত আগত অব্যয় পদ এবং অন্য ভাষা থেকে আসা অব্যয় পদ।
বাংলা ভাষার নিজস্ব কিছু অব্যয় পদের উদাহরণ হল:-
না, বা, কি-বা, নাইবা, বুঝি, ওহে, তবু, আহারে ইত্যাদি।
এছাড়া সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় আগত কিছু অব্যয় পদের উদাহরণ হল: এবং, অতএব, বরং, সর্বদা, চমৎকার, বরঞ্চ, নচেৎ, নিতান্ত, ইদানিং, পুনশ্চ ইত্যাদি।
এগুলো ছাড়াও বিদেশী ভাষা থেকে কিছু অব্যয় পদ বাংলায় আগত হয়েছে। যেমন- মারফত, নাগাদ, সাবাস ইত্যাদি।
অব্যয় পদের প্রকারভেদ:
অব্যয় প্রধানত চার প্রকার :
১. পদান্বয়ী অব্যয়
২. সমুচ্চয়ী অব্যয়
৩. অনন্বয়ী অব্যয়
৪. অনুকার বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়।
১) পদান্বয়ী অব্যয়:
বিভিন্ন পদের মধ্যে অন্বয় বা সম্পর্ক স্থাপন করে যে সমস্ত অব্যয় তাদের পদান্বয়ী অব্যয় বলে । যেমন: সঙ্গে, নিমিত্ত, জন্য, সহ, মত ইত্যাদি।
বাক্যে প্রয়োগ :
‘বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি।’
‘দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে।’
‘সুভাষ অরিত্রর চেয়ে বয়সে বড়ো বই ছোটো নয়।’
পদান্বয়ী অব্যয়কে প্রয়োগ অনুযায়ী কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) সাদৃশ্যবাচক অব্যয়:- বাক্যের অন্তর্গত দুটি পদের সাদৃশ্য বোঝানোর জন্য যে অব্যয় ব্যবহৃত হয়, তাকে বলা হয় সাদৃশ্যবাচক অব্যয়।
যেমন- মায়ের মতো আপন কে আর হয়?
বিদ্যাসাগরের ন্যায় বিদ্যান এ জগতে দুর্লভ।
খ) সীমাবাচক অব্যয় :- সীমা বোঝাতে বাক্যে যে অব্যয়পদ ব্যবহার করা হয়, তাকে বলা হয় সীমাবাচক অব্যয়। যেমন–
কাল পর্যন্ত তাকে আমি দেখিনি।
সেই থেকে দুজনের ভাব-ভালোবাসা।
গ) ব্যতিরেকবাচক অব্যয় :- ছাড়া, ব্যতীত, ভিন্ন ইত্যাদি অর্থ বোঝাতে যে অব্যয় বাক্যে ব্যবহার করা হয়, তাকে ব্যতিরেকবাচক অব্যয় বলা হয়। যেমন—
দুঃখ বিনা সুখ লাভ হয় কি মহীতে ?
আসক্তিতে দুঃখ বাড়ে বই কমে না।
সে ছাড়া কেউ জানে না।
কানু বিনে গীত নাহি আর।
২) সমুচ্চয়ী বা বাক্যান্বয়ী অব্যয় :-
যে অব্যয় একটি পদের সঙ্গে অন্য পদের, একটি বাক্যাংশের সঙ্গে অন্য বাক্যাংশের কিংবা একটি বাক্যের সঙ্গে অন্য বাক্যের সংযোজন বা বিয়োজন ঘটায়, তাকে সমুচ্চয়ী অব্যয় বলা হয়। যেমন:-
বাক্যে প্রয়োগ :
‘অস্ত্র নির্মাণ তথা সৈন্য সমাবেশের প্রচুর ব্যয় হইবে।’
সুখ বা দুঃখ কোন কিছু সে গ্রাহ্য করে না।
উপরিউক্ত উদাহরণগুলিতে তথা এবং বা অব্যয় পদ দুটি বাক্যের সংযোজন বা বিয়োজনের কাজ করেছে।
এই শ্রেণীর অব্যয়কে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।
ক) সংযোজক অব্যয় :- যে অব্যয় বাক্যের অন্তর্গত বিভিন্ন পদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সংযোগ স্থাপন করে তাকেই বলে সংযোজক অব্যয়। যেমন:- এবং, ও, আরো, তথা ইত্যাদি।
উদাহরণ :-
তিনি এবং আমি সান্ধ্য ভ্রমণে যাব।
শিক্ষিত মানুষ দেশ তথা সমাজের জন্য উপযোগী।
তুমি আর আমি দুজনে মিলে কাজটা শেষ করলাম।
খ) বৈকল্পিক অব্যয় :- অথবা, কিংবা, না, বা ইত্যাদি।
যেমন:
অজয় অথবা বিজয় কেউ একজন যাবে।
ভালো কিংবা মন্দ কিছু একটা হতে পারে।
গ) সংকোচক অব্যয় :- কিন্তু, পরন্তু, অথচ, অধিকন্তু, তবু, তথাপি, বটে ইত্যাদি।
উদাহরণ:-
“তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে।”
সে মুখ খুলল কিন্তু বলতে পারল না।
ঘ) ব্যতিরেকাত্মক অব্যয় :- নতুবা, না হইলে, যদি না ইত্যাদি।
উদাহরণ:-
তাড়াতাড়ি যেতে হবে, নইলে গাড়ি ধরতে পারবো না।
অদৃষ্ট যদি না খারাপ হবে, তাহলে এমন কেন হবে !
ঙ) প্রশ্নসূচক অব্যয় :- কী? না? নাকি? তাই নাকি? বটে? ইত্যাদি।
যেমন:
বড্ড দূর, তাই না ?
মারবে নাকি ?
তোমার নাম কী ?
চ) কারণাত্মক অব্যয় :- যেহেতু, কারণ, বলিয়া ইত্যাদি।
যেমন:
মানুষের শান্তি নাই, কারন মানুষ লোভী।
আমি যেহেতু ক্লান্ত তাই আর হাঁটতে পারব না।
ছ) সংশয়বাচক অব্যয় :- যদি, যদি বা, যদি নাকি, যদি না হয় ইত্যাদি।
যেমন:
আর যদি এসেই পড়েন তাহলে ?
জ) সিদ্ধান্তবাচক অব্যয় :- তবে, তাই, সুতরাং, তার জন্য, কাজেই, সেইজন্য,বোধহয় ইত্যাদি।
যেমন:-
বৃষ্টি নেমেছে, সুতরাং বিকেলে ঠান্ডা পড়বে।
কাজ আছে তাই আমাকে যেতেই হবে ।
ঝ) হেতুবাচক অব্যয় :- যে অব্যয় হেতু বা কারণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয় তাকে হেতুবাচক অব্যয় বলে ।
যেমন-কারণ,বলে,কেননা,এইজন্য,যেহেতু,এইহেতু ইত্যাদি।
আমি আজ যেতে পারছি না কারণ বৃষ্টি পড়ছে ।
তুমি এসেছ বলে খুশি হয়েছি ।
ঞ) সমাপ্তিসূচক অব্যয় :- শেষে, শেষটায়, যাহাতে ইত্যাদি।
যেমন: শেষটায় সভা পন্ড হবে কে জানত।
ঠ) নিত্যসম্বন্ধী অব্যয় বা সাপেক্ষ অব্যয় :- যে সকল অব্যয় পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত অর্থাৎ একটিকে ব্যবহার করলে আর একটিকে ব্যবহার করতেই হয় তাকে নিত্যসম্বন্ধী অব্যয় বলে ।
যেমন-
যেমন- তেমন , যত-তত , যখন – তখন , ইত্যাদি ।
যত মত তত পথ ।
যখন তোমার বাড়ি গিয়ে ছিলাম তখন তুমি পড়ছিলে ।
ড) বিয়োজক অব্যয় :- দুই বা তার বেশি পদ বা বাক্যকে বিয়োজনের মাধ্যমে পরস্পরের থেকে আলাদা করার ক্ষেত্রে যে অব্যয়পদ ব্যবহৃত হয়, তাকে বিয়োজক অব্যয় বলা হয়। যেমন-
উদাহরণ:-
কোন স্টেশনটা আগে পরে নৈহাটি না কাঁচরাপাড়া?
বনে নয় মনে মোর পাখি আজ গান গায়।
আজ অথবা কালকের মধ্যেই তিনি এসে পড়বেন।
৩. অনন্বয়ী অব্যয় :-
বাক্যস্থ পদের সাথে যে সকল অব্যয়-এর সরাসরি সম্পর্ক নেই, মনের বিষয়, হর্ষ, ঘৃণা, ভয়, ইত্যাদি ভাবপ্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হয়, সেই সকল অব্যয়কেঅনন্বয়ী বা ভাববাচক অব্যয় বলা হয়ে থাকে। যেমন- ছি ছি, হায় হায়, আজ্ঞে, আহা, মরি মরি ইত্যাদি।
উদাহরণ:
আজ্ঞে, তুমি যা বলেছ সবই সত্যি।
আহা, লোকটা অকালে মরল।
Read More : বিশেষণ পদ কাকে বলে ? || বিশেষণ পদের শ্রেণিবিভাগ
অনন্বয়ী অব্যয় চার ধরণের –
ক। ভাবপ্রকাশক অব্যয়
খ। সম্বোধনসূচক অব্যয়
গ। প্রশংসাসূচক অব্যয়
ঘ। বাক্যালঙ্কার অব্যয়
ক। ভাবপ্রকাশক অব্যয় :- যে অব্যয় মনের বিভিন্ন ধরণের ভাব প্রকাশ করে তাকে ভাবপ্রকাশক অব্যয় বলে । আনন্দ,বেদনা,হর্ষ,বিষাদ,ঘৃণা,বিষ্ময়,ক্রোধ ইত্যাদি এই অব্যয়ের দ্বারাপ্রকাশ পায় ।
যেমন- আচ্ছা,বেশ,বাঃ,চমৎকাত,উঃ,ও বাবা, ও মা, হায় হায় , আহা রে ইত্যাদি ।
বাঃ ! খুব সুন্দর পাখি ।
“ও বাবা !মড়াৎ করে পড়েছি সড়াৎ জোরে ।
খ। সম্বোধনসূচক অব্যয় – যে অব্যয় দিয়ে কাউকে সম্বোধন করা হয় , তাকে সম্বোধনসূচক অব্যয় বলে ।
যেমন- হে,ওহে,ওগো,রে,ওরে,অয়ি,ওলো,এ,ও ইত্যাদি ।
“রে প্রমত্ত মন মম , কবে পোহাইবে রাতি ?”
“ওগো ,আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে ।”
গ। প্রশংসাসূচক অব্যয় :- যে অব্যয়ের দ্বারা প্রশংসা প্রকাশ করা হয় তাকে প্রশংসা সূচক অব্যয় বলে। যেমন:- বাহ! খুব ভালো অভিনয় করেছ।
আ মরি বাংলা ভাষা!
শাবাশ! আজ খেলায় খাসা গোল করেছ।
ঘ। বাক্যালংকার অব্যয় :- যে অব্যয় বাক্যের অর্থের পরিবর্তন না করে শুধু বাক্যের অর্থসৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তাকে বাক্যালংকার অব্যয় বলে। এই অব্যয়গুলির নিজস্ব কোনো অর্থ থাকে না,কিন্তু বাক্যের অর্থের বৈচিত্র্য সম্পাদন করে ।
যেমন- তো,তাই,না,আর,যে ইত্যাদি ।
“এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয় ।”
“কত না দিনের দেখা,কত না রূপের মাঝে !”
৪. ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বা অনুকার অব্যয় :-
যে সকল অব্যয় কোনো বাস্তব ধ্বনি অথবা অনুভূতিগ্রাহ্য ভাবের ব্যঞ্জনা প্রকাশ করে তাকে ধ্বন্যাত্মক অব্যয় বলে।
যেমন- খাঁ খাঁ ,কলকল,শনশন, ঝনঝন, বনবন, গুনগুন টুপটুপ ,গুরুগুরু ,ফিসফিস, টুপুর টাপুর ইত্যাদি।
উদাহরণ:-
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি। ”
ধ্বন্যাত্মক অব্যয়গুলিকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় –
(ক) অনুকার ধ্বন্যাত্মক অব্যয় :- শ্রুতিগ্রাহ্য ধ্বনির অনুকরণে যেসব ধনাত্মক অব্যয় ব্যবহৃত হয় সেগুলি অনুকার ধ্বন্যাত্মক অব্যয়।
যেমন:-
‘‘হাতে লন্ঠন করে ঠনঠন।’’
‘‘বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর।”
(খ) ভাবপ্রকাশক ধ্বন্যাত্মক অব্যয় :- যেসব ধনাত্মক অব্যয় কোন অনুভূতি, ভাব বা অবস্থাকে প্রকাশ করে, তাকে বলা হয় ভাবপ্রকাশক ধনাত্মক অব্যয়। যেমন-
‘ রাগে গা রিরি করে উঠল।’
‘ চারিদিকে শুধু ধু-ধু মাঠ।’
Check Full Class on YouTube