ছুটি গল্পের বিষয়বস্তু | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | একাদশ শ্রেণি বাংলা 2nd Semester
গল্প :- ‘ ছুটি ’
লেখক:- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উৎস:-
‘ছুটি’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক বাংলা ভাষায় রচিত একটি ছোটগল্প। এটি ১২৯৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে রচিত। ১৮৯২ সালে ডিসেম্বর মাসে ” সাধনা” পত্রিকায় ‘ ছুটি ‘ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে গল্পটি ‘ গল্পগুচ্ছ ‘ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়।
চরিত্র :-
ফটিক:- ১৩-১৪ বছর বয়সের এই ছেলেটি গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র।
মাখনলাল:- ফটিকের একমাত্র কনিষ্ঠ ভাই।
বিশ্বম্ভরবাবু:-ফটিকের মামা।
অন্যান্য চরিত্র :- ফটিকের মা এবং ফটিকের মামী।
ছুটি গল্পের বিষয় বস্তু :-
রবীন্দ্রনাথের ‘ ছুটি ‘ গল্পটি একটি গ্রাম্য বালকের মর্মযন্ত্রণার করুন কাহিনি। এখানে দেখা যায় প্রকৃতির কোল ছিন্ন ক’রে গ্রাম্য প্রকৃতির রাজ্যে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা একটি সন্তানকে শহরের যান্ত্রিক পরিবেশে নিয়ে যাওয়া হয়। এর ফলে সে জীবন যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মুক্তির সন্ধান করে। কিন্তু উন্নতির প্রতিভূ যান্ত্রিক জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া কখনোই সম্ভব হয় না । আর তাই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে প্রকৃতির কোলে মুক্তি পেতে হয়েছে তাকে। গল্পটির কাহিনি শুরু হয়েছে এইভাবে –
‘ছুটি’ গল্পে ফটিক এক ডানপিটে গ্রাম্য ছেলে। সে সেখান থেকে মামার সাথে শহরে আসে ঘটনাচক্রে। কৈবর্তের গ্রাম থেকে শহর কলকাতায় এসে তার মানসিক দুরবস্থা এবং পরিণতিতে মৃত্যু আগাগোড়া একটা মনস্তাতত্ত্বিক বিষয়ের উপর দাঁড়ানো। গল্পটিতে বয়ঃসন্ধিকালীন ছেলেটির মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন দিক ফুটে উঠেছে।। গ্রামের বালকদের সর্দার ছিল দুরন্ত স্বভাবের ফটিক। ফটিকের নেতৃত্বেই গ্রামের ছেলেরা নতুন নতুন খেলার উদ্ভাবন করত। এরকমই একদিন নদীর ধারে রাখা শালগাছের গুঁড়িকে নিয়ে খেলার সময় ফটিকের ছোটোভাই মাখনলাল তার ওপরে চেপে বসে। তখন মাখনলালকে সুদ্ধ সেই শালকাঠের গুঁড়িটিকে গড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং মাখন মাটিতে পড়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরে গিয়ে সে মার কাছে ফটিকের নামে অভিযোগ করে যে, ফটিক তাকে মেরেছে। ফটিকের মার নির্দেশে ফটিককে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। ফটিক ভাইকে মারার কথা অস্বীকার করে, কিন্তু মাখন মারার অভিযোগ জারি রাখে। ক্রুদ্ধ ফটিক মিথ্যে কথা বলার জন্য এবার মাখনকে সত্যিই চড় মারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মা ফটিককে পালটা চড় মারলে ফটিক মা-কে ঠেলে দেয়। এই নিয়ে যখন গোলযোগ চলছে, তখনই ফটিকদের বাড়িতে আগমন ঘটে তার মামা বিশ্বম্ভরবাবুর, যিনি পশ্চিমে কাজের জন্য বহুদিন বাইরে ছিলেন। তার আসার ফলে বাড়িতে বেশ সমারোহ হয়। বিদায় নেওয়ার কয়েকদিন আগে বিশ্বম্ভরবাবু তাঁর বোনের কাছে যখন ভাগিনাদের পড়াশোনার খবর নেন, তখন ফটিকের মা মাখনের প্রশংসা করলেও, ফটিকের ব্যাপারে নানা অভিযোগ জানান। বিশ্বম্ভরবাবু ফটিককে উপযুক্ত লেখাপড়া শেখানোর জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। ফটিকের মা তাতে সম্মতি দেন। ফটিকও এই প্রস্তাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। সে যাওয়ার সময় তার সমস্ত খেলার জিনিসগুলি মাখনলালকে উদারভাবে দান করে দিয়ে যায়। কিন্তু মামার বাড়িতে মামির তরফ থেকে সে প্রত্যাশিত অভ্যর্থনা পায় না, তার মামি তাকে নিজের সংসারে অবাঞ্ছিত মনে করেন। ফটিকের যে বয়স অর্থাৎ কৈশোর এবং যৌবনের মধ্যবর্তী সময়কাল, তা সাধারণভাবে সমাজে খুব গ্রহণযোগ্য হয় না। ফটিকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নানা কারণে নানাভাবে তাকে একাধিকবার তিরস্কৃত হতে হয়। ধীরে ধীরে বাড়ির জন্য, গ্রামের জন্য মন খারাপের এক অনুভূতি ফটিকের সমস্ত মনকে অধিকার করে নেয়, সেইসঙ্গে তার অসহায় মন মা-র জন্য আকুল হয়ে ওঠে। স্কুলে পাঠ অমনোযোগী ফটিককে প্রায় নিয়মিত শিক্ষকের মার খেতে হত। বই হারিয়ে ফেলার ঘটনায় তার সমস্যা আরও বেড়ে যায়। কারণ, স্কুলের পড়া তৈরি করে আসা তার পক্ষে সম্ভব হয় না।
গ্রাম্য বালকের মনের গভীরে কষ্টের কথা কেউ জানতে পারল না। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, তার মামাতো ভাইরা তার সঙ্গে সম্পর্কের কথা স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করত, বরং কোনোভাবে ফটিক অপ্রস্তুত হলে তারা আনন্দ উপভোগ করত। একদিন মামির কাছে নিরুপায় হয়ে বই হারানোর কথা বললে ফটিককে আবারও তিরস্কৃত হতে হয়। অভিমানী ফটিকের মনে হয় পরের পয়সা নষ্ট করে সে অনুচিত কাজ করছে। মায়ের প্রতি তার অভিমান তীব্রতর হয়। এই সময়েই একদিন ফটিক স্কুল থেকে ফেরার পরে অসুস্থ বোধ করে। তার জ্বর আসে। সে বুঝতে পারে যে এই অসুস্থতা তার মামির কাছে এক অনাবশ্যক উপদ্রব হয়ে উঠতে পারে, আর সে কারণেই পরদিন সকালে ফটিক নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। চারপাশে তার খোঁজ পাওয়া যায় না। ফটিক আসলে মুক্তির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এইসব যন্ত্রণায় ভরা যান্ত্রিক জীবন ফটিককে ব্যথিত করে। সে পালিয়ে মুক্তি পেতে চায় । অবশেষে ফটিকের কোনো সন্ধান না পেয়ে বিশ্বম্ভরবাবু পুলিশে খবর দিতে বাধ্য হন। সন্ধ্যার সময় পুলিশের গাড়িতে ফটিককে ফিরিয়ে আনা হয়। এই সময় বৃষ্টিতে ভেজার কারণে তার জ্বর আসে। জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে থাকে ফটিক । ডাক্তারবাবুও শঙ্কা প্রকাশ করেন।
Read More : ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর || একাদশ শ্রেণি বাংলা 2nd Semester
অবশেষে তার মাকে খবর দেওয়া হয়। মা এলেও ফটিকের জ্ঞান ফেরে না । ফটিকের অসুস্থতায় তিনি আর্তনাদ করে ওঠেন। ফটিক কাউকে লক্ষ না করেই পাশ ফিরে মৃদুস্বরে মা-কে উদ্দেশ্য করে বলে যে তার ছুটি হয়েছে, সে বাড়ি যাচ্ছে। গভীর জ্বরের ঘোরে সে মুক্তির প্রত্যাশা করে । শেষ পর্যন্ত সে ছুটি পায় জীবন থেকে ও জীবনের যন্ত্রণা থেকে । এভাবেই সমাপ্ত হয়েছে ছুটি গল্পটি। এই গল্প আসলে প্রকৃতির কোলচ্যুত একটি বালকের কাহিনি । জীবাত্মার সঙ্গে মানবাত্মার এক চিরন্তন সম্পর্কের কাহিনি। যে বন্ধন কখনোই জোর করে ছিন্ন করা উচিত নয়।