ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর || একাদশ শ্রেণি বাংলা 2nd Semester
ছুটি গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের ফটিক চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো। ৫
উত্তর:- রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পে প্রকৃতির কোল বিচ্যুত এক বালকের মর্মযন্ত্রণার কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই গল্পের সেই অসহায় কেন্দ্রীয় চরিত্রটির নাম ফটিক। মানব-প্রকৃতির রূপকার রবীন্দ্রনাথ আলোচ্য ছোটোগল্পে ফটিক চরিত্রের মধ্যে কতগুলি বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলেছেন। সেগুলি হল –
১। নেতৃত্বদানকারী
২। স্বাধীনচেতা
৩। প্রকৃতির সন্তান
৪। সত্যবাদী
৫। স্নেহের কাঙাল
৬। আত্ম মর্যদাসম্পন্ন
৭। নিঃসঙ্গ
নেতৃত্বদানকারী :
গল্পের শুরুতেই দেখা যায় গল্পের নায়ক ফটিক তার খেলার সাথীদের নিয়ে উন্মুক্ত প্রকৃতির বুকে স্বাধীনভাবে খেলা করছিল। তার সঙ্গীদের কাছে সেই ছিল নেতা। বালকদের মধ্যে এই নেতৃত্বদানের গুন সকলের থাকে না। ফটিক শুরু থেকেই এই গুণের অধিকারী।
স্বাধীনচেতা :
ফটিক যে স্বাধীনচেতা সে বিষয়ে সংশয় নেই। ঘুড়ি ওড়ানো, নদীতে সাঁতার কাটা,‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ বলে ঘুরে বেড়ানোর মধ্য দিয়ে তার মন আনন্দরসে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত। তার স্বাধীন মন কখন কারো তোয়াক্কা করে নি ।
প্রকৃতির সন্তান :
‘পথের পাঁচালী’র অপু , ‘পুঁইমাচা’ গল্পের খেন্তির মতই ফটিকও ছিল প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির কোলে লালিত সন্তান ফটিক কলকাতায় মামা ও মামির আশ্রয়ে এসে প্রথম উপলব্ধি করে, নাগরিক জীবনে সে কতটা অবাঞ্ছিত। ফটিকের গ্রামে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা শুধু মায়ের জন্য নয়,
তার অন্তরাত্মার সঙ্গে প্রকৃতির এক নিবিড় একাত্মতার কারণে। শিশুর শিক্ষালাভে যান্ত্রিক পরিবেশ যে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ, সেই মনোভাবই সহানুভূতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এই গল্পে তুলে ধরেছেন।
সত্যবাদী :
ফটিক চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল তার সত্যবাদী স্বভাব। ফটিক তার ভাই মাখনলালের গালে চড় মেরে ভাইয়ের মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। আবার সে কলকাতা যাত্রার পূর্বে খেলার ঘুড়ি, লাটাই, ছিপ ভাইকেই সমর্পণ করে তা সম্পূর্ণ ভোগের অধিকার দিয়ে যায়। গল্পের কোথাও ফটিকের মিথ্যাবাদের দৃষ্টান্ত নেই।
স্নেহের কাঙাল :
ফটিক আসলেই স্নেহের কাঙাল। আলোচ্য গল্পে দেখা যায়, পিতৃহীন ফটিক তার
মায়ের স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। সে বোঝে তার মায়ের হৃদয়ের অধিকাংশটাই জুড়ে রয়েছে ভাই মাখন। তাই মামা বিশ্বম্ভরবাবুর সস্নেহ প্রস্তাবে রাজি হয়ে সে কলকাতা চলে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে মামির স্নেহহীন সান্নিধ্য তাকে পীড়িত করে। তাই স্নেহবুভুক্ষু ফটিক শেষপর্যন্ত মামারবাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। স্নেহ বঞ্চিত ফটিককে কেউ কখনো বুঝতে পারে নি।
আত্ম মর্যদাসম্পন্ন :
ফটিক ভীষণ আত্ম মর্যদাসম্পন্ন । খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে মাখন
যখন তাকে মেরে বাড়ি চলে গিয়েছে, তখন অভিমানে সে আনমনে বসে থেকেছে। মাখনের মিথ্যে অভিযোগে মা যখন তাকে প্রহার করেছে, সেই মুহূর্তে মৃদু প্রতিবাদ করলেও মায়ের উপর তার অভিমান হয়েছে। আপাত মাতৃস্নেহবিহীন গৃহ পরিবেশে উপেক্ষিত ফটিক তাই মামার প্রস্তাবে সহজেই কলকাতা যেতে রাজি হয়ে গিয়েছে। আবার কলকাতা গিয়ে মামির হৃদয়হীন আচরণে অভিমান করে সে বাড়ি ছেড়েছে। তার ভেতরের যন্ত্রণার কথা কাউকেই বলে নি। নিজে কষ্ট পেলেও কাউকেই কষ্ট যন্ত্রণা দেয় নি। এটা তার আত্মসম্মানে বাঁধে।
নিঃসঙ্গ :
এই বয়েসের বালকেরা থাকে বয়ঃসন্ধিকালীন সমস্যায় জর্জরিত। বয়ঃসন্ধিকালীন অবস্থায় নানা ব্যর্থতা কিশোর-কিশোরীদের অন্তরকে পীড়িত করে। ‘ছুটি’ গল্পে ফটিকের প্রতি মামির রূঢ় আচরণ, শিক্ষকের প্রহার, বই হারিয়ে ফেলা, মামাতো ভাইদের নির্মম ব্যবহার, বন্ধুত্বহীন নিঃসঙ্গ জীবন ইত্যাদি ঘটনার ফলে মানসিক দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত ফটিকের অন্তরাত্মা। বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে বুঝতে না পারার অক্ষমতাই তাকে অবসাদগ্রস্ত করে তুলেছে। কারও সহৃদয়তা তাকে বুকে টেনে নেয় নি। তাই আগাগোড়াই সে ছিল নিঃসঙ্গ।
আলোচ্য গল্পে রবীন্দ্রনাথ ফটিকের জীবনের কাহিনি তুলে এনে কিশোর মনের সমস্যাকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনই দেখিয়েছেন প্রকৃতির সঙ্গে যার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক; প্রকৃতির সঙ্গে বিচ্ছেদে তার অস্তিত্ত্ব কীভাবে সংকটে পড়ে যায় । ফটিকের এই মর্মান্তিক কাহিনি বাংলা সাহিত্যে এক দীর্ঘশ্বাস হয়ে আমাদের মনে থেকে যাবে চিরকাল।
সমস্ত ক্লাসগুলি নিয়মিত ভিডিও আকারে পেতে চলে আসো আমাদের YouTube Channel এ।