বিদ্যাপতির ভাব সম্মিলন কবিতার উৎস ,কবি পরিচিতি, ব্যাখা ও বিষয়বস্তু আলোচোনা
১। বৈষ্ণব পদ কী ?
মধ্যযুগে রচিত রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক ছোটো ছোটো কবিতা বা গানগুলিকে বলা হয় বৈষ্ণব পদ।
২। ভাব সম্মিলন কী ?
বৈষ্ণব পদাবলির বিভিন্ন রসপর্যায় রয়েছে। রাধাকৃষ্ণের মিলন, বিরহ , অভিমান এরকম বিভিন্ন মানসিক অবস্থা নিয়ে রচিত রসপর্যায় গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – পূর্বরাগ , অনুরাগ , মান , অভিসার , মাথুর , ভাবোল্লাস , মিলন ইত্যাদি।
এই পর্যায়গুলির মধ্যে একটি পর্যায় হল ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলন। ভাব সম্মিলন হল শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে যাবার পরে রাধার মনে প্রিয় বিরহের যন্ত্রণা বা মাথুর শুরু হয় সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে রাধা ভাবে সা কল্পনাতে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হন এবং বিরহের বদলে এক আনন্দের অনুভূতি লাভ করেন। এই ভাব কল্পনায় মিলনের পদগুলিই হল ভাবোল্লাস বা ভাব সম্মিলনের পদ।
মনে রেখো ভাব সম্মিলন এই কবিতার নাম নয় , এটি একটি বৈষ্ণবপদের রস পর্যায়ের নাম । এরকম আরো অনেক কবির অনেক ভাবোল্লাসের পদ রয়েছে।
৩। কবি পরিচিতি : বিদ্যাপতি
কবি বিদ্যাপতির জন্ম দ্বারভাঙা জেলার মধুবনী পরগনার বিসফী গ্রামের এক বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে। তার কৌলিক উপাধি ঠক্কুর বা ঠাকুর। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মিথিলার ছয়জন রাজা ও একজন রানীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ‘কীর্তিলতা’ ‘ভূপরিক্রমা’, ‘কীর্তিপতাকা’, ‘পুরুষ পরীক্ষা’, ‘শৈবসর্বস্বসার’, ‘গঙ্গাবাক্যাবলি’, ‘বিভাগসার’, ‘দানবাক্যাবলি’, লিখনাবলি, দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী। তিনি রাধাকৃষ্ণবিষয়ক প্রায় আট শ’ পদ রচনা করেন। জীবৎকালে বিখ্যাত কবি ও পণ্ডিতরূপে তার প্রতিষ্ঠা ছিল। তাঁর পদগুলি মিথিলা ছাড়িয়ে বাংলা দেশেও বেশ জনপ্রিয়তালাভ করেছে।
৪। কবিতার ভাষাঃ ব্রজবুলি
ব্রজবুলি মূলত এক ধরণের কৃত্রিম মিশ্রভাষা। মৈথিলি ও বাংলার মিশ্রিত রূপ হলো ব্রজবুলি ভাষা। ব্রজবুলি মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের দ্বিতীয় কাব্যভাষা বা উপভাষা। এই ভাষায় শব্দগুলি খুব শ্রুতিমধুর। কঠিন শব্দগুলি ভেঙে মিস্টিভাবে উচ্চারিত হয়। এজন্যে ব্রজবুলি খুব মিষ্টি, সুরময়, গীতিময় ভাষা। বিদ্যাপতির ব্রজবুলি ভাষার পদগুলি বাংলা সাহিত্য সমাজে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথও এই ব্রজবুলি ভাষায় ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ রচনা করেন।
৫। কবিতার মূল ভাব :
কংস বধের জন্য কৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় চলে গেলে রাধা প্রিয়তমের জন্য বিচ্ছেদ বেদনায় কাতর হয়ে পড়েন । শ্রীকৃষ্ণ আর বৃন্দাবনে ফিরে আসেননি, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়ার জন্য ভাবের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীরাধিকা। তাই মনোজগতে ভাব কল্পনায় শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন তিনি। প্রবল বিরহ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে অন্তরের মধ্যেই নিত্যদিন মিলনের আশায় থাকতেন রাধা। এই মিলনে শ্রীকৃষ্ণকে হারিয়ে ফেলার কোনো ভয় নেই। দীর্ঘদিন কৃষ্ণকে কাছে না পেয়ে বিরহে কাতর রাধা, কৃষ্ণকে নিজের অন্তরের মধ্যে ফিরে পাওয়ার পর, তাঁর মনে মিলনের যে উল্লাস জেগে
উঠেছে, সেই আনন্দ প্রকাশ করতেই বিদ্যাপতি এই পদ রচনা করেন। রাধা তাঁর সেই আনন্দ উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন তাঁর সখীদের কাছে । বিদ্যাপতির এই কবিতাটি সেই কথাকেই তুলে ধরছে আমাদের কাছে।
৬। কবিতার ব্যাখ্যা – শব্দ – অর্থ তাৎপর্য আলোচনা :
কহব : কহিব, বলিব।
চিরদিনে : দীর্ঘ দিনে / দীর্ঘদন পর
মন্দিরে : ঘরে
সুধাকর : চাঁদ
পিয়া-মুখ-দরশনে : প্রিয়তমর মুখ দেখে
ভেল : হল
মহানিধি : মহামূল্যবান রত্ন
গীরিষির : গ্রীষ্মের / গরমকালের
বরিষার : বর্ষার
দরিয়া : নদীর
ভণয়ে : বলছে
দুখ : দুঃখ
বরনারি : শ্রেষ্ঠা নারী বা সুন্দরী
ওর : অন্ত, পার, সীমা
মাধব : শ্রীকৃঘ্ন।
দেল : দিল
আঁচর : আঁচল
তব : তাহলেও, তবুও
ওঢ়নী : ওড়না / চাদর
বা : বাতাস
ছত্র : ছাতা
না : নৌকা
সুজনক : সুন্দর বা ভালো মানুষ
দিবস দুই-চারি : দু-চারদিন
Read More : ছুটি গল্পের বিষয়বস্তু | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | একাদশ শ্রেণি বাংলা
গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন তুলে ধরা হল :
প্রশ্ন ১. “পাপ সুধাকর যত দুখ দেল।”— সুধাকরকে ‘পাপী’ বলা হয়েছে কেন ?
উত্তর: ‘সুধাকর’ শব্দের অর্থ হল চাঁদ । সুধাকরকে পাপী বলার কারণ হল প্রিয়তম কৃষ্ণের বিরহে রাধিকা যখন দুঃখে কাতর
তখন চাঁদের মায়াবী জ্যোৎস্না যেন আরও বেশি করে তাঁকে কৃষ্ণের কথা মনে করাচ্ছে। অথচ তিনি শ্রীকৃষ্ণের কাছে যেতে পারছেন না। শ্রীরাধিকার
বিচ্ছেদ বেদনাকে বড় করে তোলার জন্য সুধাকরকে পাপী বলা হয়েছে।
প্রশ্ন ২. ‘যত দুখ দেল’ বলতে এখানে কীসের ইঙ্গিত করা হয়েছে ?
উত্তর: শ্রীরাধিকাকে ফেলে রেখে প্রিয় কৃষ্ণ গিয়েছেন মথুরায়। সমগ্র বৃন্দাবন বিরহে কাতর হয়ে উঠেছে। রাধিকার বিরহ-কাতরতায় বৃন্দাবনের বক্ষে নেমে আসা মায়াবী চাঁদের জ্যোৎস্নালোক সেই বেদনাকে
দ্বিগুণ করেছে। চাঁদের প্রতি তাই শ্রীরাধিকার মনে বড়োই আক্রোশ জন্মেছে প্রিয়-বিচ্ছেদে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। প্রিয়-মিলনের পূর্বে রাধার
এরূপ অবস্থার বর্ণনাতেই ‘যতদুখ’ শব্দবন্ধটির অবতারণা।
প্রশ্ন ৩. “আঁচর ভরিয়া যদি মহানিধি পাই। তব হাম পিয়া দূর দেশে না পাঠাই।।” – “মহানিধি’-র আক্ষরিক ও অন্তর্নিহিত অর্থ কী ?
উত্তর: বৈষ্ণব পদকর্তা বিদ্যাপতি ‘মহানিধি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ বুঝিয়েছেন মহৈশ্বর্য বা মহামূল্যবান সম্পদ। পার্থিব ধনরাশি, যা মানুষকে বিত্তশালী, লোভী ও স্বার্থপর করে তোলে।
অন্তর্নিহিত অর্থ: পাঠ্যানুসারে ‘মহানিধি’ শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থ স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। রাধিকার কাছে শ্রীকৃয় হলেন মহামূল্যবান রত্ন সমান, তাঁর হৃদিমাণিক্য, তাঁর অভিন্ন সত্তা।
প্রশ্ন ৪. ‘মহানিধি’ পেলে বক্তা কী করবেন ?
উত্তর : শ্রীকৃষ্ণ মথুরা চলে যাওয়ার পর শ্রীরাধিকা যে বিরহ
যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছিলেন, সেই অন্তরের বিরহ ক্লেশ কাটিয়ে উঠেছেন। যে শারীরিক বিচ্ছেদ রাধিকাকে পীড়িত করছিল, সেই বিচ্ছেদ-বেদনা রাধিকার
মানসলোকে এসে হঠাৎই প্রশমিত হয়েছে। রাধা ভাবলোকে অনুভব
করেছেন শ্রীকৃষ্ণকে। তাঁরা এখন অভিন্ন সত্তা। মানসলোকে ঘটেছে যুগল কোনো মহৈশ্বর্যের বিনিময়েই তিনি আর তাঁকে দূরদেশে চলে যেতে দেবেন না।
প্রশ্ন ৫. ” শীতের ওড়নি পিয়া গীরিষির বা । / বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।।” – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি ব্যাখ্যা করো ।
উত্তর : কবি বিদ্যাপতি রচিত ‘ভাব সম্মিলন’ কবিতায় আলোচ্য অংশে কবি বুঝিয়েছেন প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণ, কেবল শ্রীরাধিকার প্রেমিকই নন, তিনি তাঁর ত্রাতাস্বরূপ। রাধার জীবনে কৃষ্ণের গুরুত্ব কতখানি, তা বোঝাতে কবি বিদ্যাপতি কথাটি ব্যবহার করেছেন।
তাৎপর্য :
দীর্ঘদিনের কৃষ্ণবিচ্ছেদ শ্রীরাধিকাকে বিরহে কাতর করে তুলেছিল। প্রিয়তমকে মানসলোকে পেয়ে তাঁর আনন্দের আর সীমা নেই।
ভাবের অতিশয্যে ভেসেছেন শ্রীরাধিকা। সখীর কাছে সেই আনন্দ ব্যক্ত করছেন, নানা অলংকার-উপমায় ভরিয়ে তুলছেন শ্রীকৃষ্ণকে। শ্রীকৃষ্ণ যে
তাঁর কাছে কতটা মূল্যবান, তা বোঝাতে কী বলবেন, কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। তিনি সখীকে বলছেন, ওড়না বা উত্তরীয় যেমন শীতের প্রকোপ থেকে শরীরকে রক্ষা করে তেমনই শ্রীকৃষ্ণ যেন শ্রীরাধিকার অসময়ের রক্ষক, আবার প্রবল গ্রীষ্মের দিনে সুশীতল বাতাসের মতো শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধিকার জীবনে আনেন প্রশান্তি। কৃষ্ণ যেমন ছাতার ন্যায় প্রতিকূলতার ধারা বর্ষণ থেকে রাধিকাকে রক্ষা করেন, তেমনই কৃষ্ণই তাঁর জীবন নদী পারাপারের নৌকা। দুর্গম ভব পারাবারের কাণ্ডারি। রাধার জীবনে তিনি নিশ্চিন্ত আশ্রয় ও শান্তি এ কথাই আলোচ্য অংশে উপমায় তুলে ধরা হয়েছে।