বাংলা নাট্য সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের অবদান । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন দত্তের অবদান
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)
বাংলা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে মধুসূদন দত্ত এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা প্রচলিত নাট্যধারায় অভিনবত্বের আমদানি করেন। বাংলা নাট্যমঞ্চে মধুসূদনের আবির্ভাব কিছুটা আকস্মিকভাবেই। বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণ তর্করত্নের লেখা ‘রত্নাবলী’ নাটকের অভিনয় দেখে মধুসূদন বিরক্ত হয়ে লেখেন –
“অলীক কু-নাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।”
সেই বিরক্তি থেকেই মধুসূদন নিজেকে বাংলা নাটক রচনায় নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁর চেষ্টায় বাংলা নাটকে ইউরোপীয় নাট্যরীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
মধুসূদনের নাটকগুলিকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা –
১. পৌরাণিক নাটক:- শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯) , পদ্মাবতী (১৮৬০)
২. ঐতিহাসিক নাটক:- কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১)
৩. রূপক নাটক:- মায়াকানন (১৮৭৪)
৪. প্রহসন:- একেই কি বলে সভ্যতা ? (১৮৬০) , বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০)
মাইকেল মধুসূদন দত্তর নাটকগুলির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
১. শর্মিষ্ঠা (১৮৫৯)
মধুসূদনের প্রথম নাটক এটি।
মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-দেবযানী-যযাতির উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত নাটক।
৫ অঙ্কে রচিত এই নাটকটি ।
মূল চরিত্রগুলি হল- শর্মিষ্ঠা, যযাতি, দেবযানী।
নাটকটি ১৮৫৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর বেলগাছিয়া নাট্যশালায় প্রথম অভিনীত হয়।
মধুসুদনের জীবদ্দশায় এই নাটকের ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
উৎসর্গ – শ্রীযুক্ত রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ বাহাদুর তথা শ্রীযুক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বাহাদুরকে নাটকটি উৎসর্গ করা হয়।
২. পদ্মাবতী (১৮৬০)
গ্রিক নাটক ‘Apple of Discord অবলম্বনে রচিত পৌরাণিক নাটক।
নাটকটি ৫ অঙ্ক বিশিষ্ট ।
মূল চরিত্রগুলি হল ইন্দ্রনীল, পদ্মাবতী, নারদ, রতী দেবী।
মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকেই প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।
মধুসূদনের জীবদ্দশায় এই নাটকের ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর বৌ বাজারে বাবু রাজেন্দ্র দত্তর বাড়িতে।
৩. বুড়ো শালিখের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০)
এটি মধুসূদনের বিখ্যাত প্রহসন।
এই নাটকের পূর্বনাম ‘ভগ্ন শিবমন্দির’।
এই নাটকে অঙ্ক সংখ্যা ২টি।
মূল চরিত্রগুলি হল- ভক্তপ্রসাদ, পঞ্চানন, গদাধর, পুঁটি, পঞ্চী।
মধুসূদনের জীবদ্দশায় এই প্রহসনটির ২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
৪. একেই কি বলে সভ্যতা ? (১৮৬০)
এটি মধুসূদনের প্রহসন জাতীয় রচনা।
ইয়ং বেঙ্গলদের ব্যঙ্গ করে এই প্রহসনটি রচিত হয়।
প্রহসনটি দুই অঙ্ক বিশিষ্ট।
প্রহসনের মূল চরিত্রগুলি হল নববাবু, কালীবাবু, বৈদ্যনাথ, প্রসন্নময়ী, নৃত্যকালী।
প্রহসনটির প্রথম অভিনয় হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই জুলাই শোভাবাজার নাট্যশালায়। পরবর্তীকালে জোড়াসাঁকো থিয়েটারেও এর অভিনয় হয়েছিল।
মধুসূদনের জীবদ্দশায় এই প্রহসনটির ২টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
৫. কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) –
এই নাটকের বিষয়বস্তু গ্রহণ করা হয়েছে কর্নেল টডের ‘রাজস্থান’ ( Annals and antiquities of Rajasthan) গ্রন্থ থেকে।
নাটকের মূল চরিত্রগুলি হল ভীমসিংহ, জগৎসিংহ, কৃষ্ণকুমারী।
মোট ৫ অঙ্ক বিশিষ্ট এই নাটকটি ।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ও প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি।
নাটকটির প্রথম মুদ্রণের ব্যয়ভার গ্রহণ করেছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর।
নাটকটি ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে ৮ই ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার নাট্যশালায় প্রথম অভিনীত হয়।
মধুসূদনের জীবদ্দশায় এই নাটকের ৩টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
৬. মায়াকানন (১৮৭৪)
মধুসূদনের শেষ নাটক এটি ।
এটি একটি রূপক নাটক।
এই নাটকটি পাঁচ অঙ্কে বিন্যস্ত।
মূল চরিত্রগুলি হল অজয়, ধুমকেতু, রামদাস, ইন্দুমতী, শশিকলা।
নাটকটি ১৮৭৪ সালের ১৮ এপ্রিল বেঙ্গল থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয়।
বাংলা নাট্য সাহিত্য মধুসূদনের অবদান :-
কেবল বাংলা কাব্য ক্ষেত্রেই নয়, নাট্যসাহিত্যেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত আধুনিকতাকে প্রতিষ্ঠা করেন। সমকালীন নাট্যধারার দুর্বলতাকে মনে রাখলে মধুসূদনের নাট্যকৃতির প্রশংসা করতেই হয়। মধুসূদনের পূর্বে বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম শ্রেণির নাটক তখনও কেউ লেখেননি।
ড. অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় তাই লেখেন—“এই দুখানি প্রহসন থেকেই দেখা যাবে মধুসূদন নানা ধরণের বাংলা, মায় উপভাষা—কতটা জানা ছিল, আর জনজীবনের সঙ্গে তিনি কতটা নিবিড় ভাবে পরিচিত ছিলেন।” বস্তুত মধুসূদন যদি আর একটিও নাটক না লিখতেন তবে এই প্রহসন দুটিই নাট্যকার মধুসূদনের কৃতিত্ব বিচারে যথেষ্ঠ হত।
আধুনিক রীতির নাটক রচনা করে মধুসূদন পরবর্তী নাট্যকারদের নাটক রচনায় বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনায়, ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি নাটক রচনায় এবং প্রহসন রচনায় মধুসূদন নাট্য ক্ষেত্রেও বিচিত্র প্রতিভার সাক্ষর রেখে গেছেন।
Also Read : বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান
Important SAQ question :
1. মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর শর্মিষ্ঠা নাটকটি কাকে উৎসর্গ করেন ?
উঃ শ্রীযুক্ত রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ বাহাদুরকে।
2.বিদেশি কোন নাটকের আদলে ‘পদ্মাবতী’ নাটকটি রচিত।
উঃ গ্রীক নাটক ‘Apple of Discord’ ।
3. মধূসূদন কোন রচনায় প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেছেন ?
উঃ ‘পদ্মাবতী’ নাটকে ।
4. ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’- প্রহসনটির পূর্ব নাম কী ছিল ?
উঃ ‘ভগ্ন শিবমন্দির’।
5. মধুসূদন ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের উপাখ্যান কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন ?
উঃ কর্নেল টডের ‘রাজস্থান’ ( Annals and antiquities of Rajasthan) গ্রন্থ থেকে ।
6.’একেই কি বলে সভ্যতা ‘- প্রহসনটির প্রকাশকাল কত ?
উঃ ১৮৬০ খ্রি.।
বাংলা নাট্য সাহিত্যে প্রথম ঐতিহাসিক ট্রাজেডির নাম কী ?
উঃ ‘কৃষ্ণকুমারী’।
মধুসূদন দত্তর শেষ নাটকের নাম কী ?
উঃ ‘মায়াকানন’ ।
মাইকেল মধুসূদন দত্তর দুটি ঐতিহাসিক নাটকের নাম লেখ।
উঃ ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও ‘মায়াকানন’ ।
নববাবু,কালীবাবু চরিত্র দুটি মধুসূদনের কোন নাটকের ?
উঃ ‘একেই কি বলে সভ্যতা’।