Primary TETSSC

বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস

বাংলা সমাজ ও সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব

মধ্যযুগের একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল চৈতন্যদেবের আবির্ভাব । চৈতন্য মহাপ্রভু (১৪৮৬ খ্রিঃ – ১৫৩৩ খ্রিঃ) ছিলেন ভারতবর্ষে আবির্ভূত এক বহু লোকপ্রিয় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী ও ধর্মগুরু মহাপুরুষ এবং ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক। তিনি গৌড়বঙ্গের নদিয়া অন্তর্গত নবদ্বীপে (অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলা) হিন্দু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শ্রীজগন্নাথমিশ্র ও শ্রীমতী শচীদেবীর গৃহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আবির্ভাবের ফলেই মধ্যযুগে বাংলাদেশে নবজাগরনের সূচনা হয়েছিল। তিনি সমাজ ও সাহিত্যকে আমূল পালটে দিতে পেরেছিলেন। এসো কথা না বাড়িয়ে দেখে নিই চৈতন্যদেবের অবদান সম্পর্কে কী কী প্রশ্ন পরীক্ষায় এসে থাকে।

প্রশ্ন ১। বাঙালির সমাজজীবনে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের কী প্রভাব পড়েছিল আলোচনা করো।

প্রশ্ন ২। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের কী প্রভাব পড়েছিল আলোচনা করো।

প্রশ্ন ১। বাঙালির সমাজজীবনে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের কী প্রভাব পড়েছিল আলোচনা করো।

উত্তর:- ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ফাল্গুনী দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাংলা দেশের সমাজ-জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে যেসব পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, সেগুলি হল—

অস্পৃশ্যতা দূরঃ শ্রীচৈতন্যদেবের ধর্ম আন্দোলনের বিস্তারক্ষেত্র ছিল সমগ্র বাঙালিসমাজ। সমস্ত সংকীর্ণতার ওপরে উঠে যেভাবে তিনি অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে মানুষে-মানুষে সমভাবের কথা বলেছিলেন, সেকালের পক্ষে তা ছিল রীতিমতো বৈপ্লবিক এক ভাবনা।

** উন্নত সংস্কৃতির সূচনা : শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাবে জনরুচির সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটেছিল। স্থূল গ্রাম্যতার পরিবর্তে পরিচ্ছন্ন মার্জিত রুচিবোধের জাগরণ ঘটেছিল জনমানসে। বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্নিগ্ধ-কোমল ভাবের বিস্তৃতি চৈতন্যপ্রভাবের অন্যতম অবদান।

অহিংস মনোভাব : ভিন্ন ধর্ম বা ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। তিনি শিখিয়েছিলেন তরু বা গাছের মতো বিনয়ী হতে।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রসার : চৈতন্যদেব গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সূচনা করে অহিংস এক ধর্মীয় বাতাবরণ সৃষ্টি করেন। যা উচ্চনীচ ভেদাভেদ দূর করে এক নতুন হিন্দু সংস্কৃতির জন্ম দেয়।

শাসক ও শাসিতের মেলবন্ধন : তুর্কি আক্রমণের পর শাসকের সঙ্গে শাসিত হিন্দুদের পরস্পর বৈরিতার সম্পর্কের সূচনা হয়েছিল । চৈতন্যদেব পেরেছিলেন বিজাতীয় শাসকের সঙ্গে শাসিত হিন্দুদের সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে তুলতে।

উন্নত উদার মানব প্রেমের বাতাবরণ সৃষ্টি : হিংসা-দ্বেষ-কলুষতাপূর্ণ বাঙালি সমাজে সর্বশক্তিমান প্রেমকে প্রতিষ্ঠিত করে শ্রীচৈতন্যদেব বাঙালিকে বাঁচতে শিখিয়েছেন। অসাম্য, বিভেদ, অনাচার, মোহ ও কুসংস্কারের বিপরীতে সামাজিক সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করে তিনি এক বিশাল সমাজ-বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, ধর্মকে কেন্দ্র করে তিনি সেকালের বাঙালি জীবনে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন, যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। এই জন্য মধ্যযুগের ষোড়শ শতকের সময়কালকে বলা হয় চৈতন্য নবজাগরণ।

Important : সম্পূর্ণ ক্লাসটি ইউটিউবে দেখতে ক্লিক করো

প্রশ্ন ২। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের কী প্রভাব পড়েছিল আলোচনা করো।

উত্তর : চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাংলা দেশের সমাজ-জীবনে যেমন পরিবর্তন ঘটেছিল, তেমনি বাংলা সাহিত্যেও অনেক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল।

চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বাংলা সাহিত্য-ধারায় যে যে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, সেগুলি হল—

বৈষ্ণব দর্শনের সূত্রপাত : চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে বৈষ্ণব পদাবলি ও বৈষ্ণব জীবনীসাহিত্য। চৈতন্যপূর্ব যুগেও বৈষ্ণব পদাবলির একটা ধারা ছিল। কিন্তু সেখানে তেমন কোনো আধ্যাত্মিক আদর্শ ছিল না। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের ফলে বৈষ্ণবধর্মের যে দার্শনিক ভিত্তি গড়ে ওঠে তারই আলোকে বৈষ্ণব পদাবলি নতুন তাৎপর্য পায়।
প্রেম ও ভক্তির অপূর্ব রস ফুটে ওঠে গোবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, বলরাম দাস, যদুনন্দন, নরহরি চক্রবর্তী প্রমুখ বৈষ্ণব কবির রচনায়।

গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ও গৌরচন্দ্রিকার পদ সৃষ্টি : বাংলা সাহিত্যে আগে থেকেই বৈষ্ণব পদাবলীর প্রচলন ছিল। যেমন , চণ্ডিদাস বিদ্যাপতির পদাবলি। চৈতন্যদেবের জীবন ও দর্শন থেকেই নতুন সাহিত্য ধারার সৃষ্টি হয় তা হল গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ ও গৌরচন্দ্রিকার পদ । চৈতন্যদেবের জীবন ও বাল্যকালের কাহিনি নিয়ে রচিত হয় গৌরাঙ্গ বিষয়ক পদ। আর যে পদগুলি কীর্তন গানের শুরুতে রাধাভাবে ভাবিত চৈতন্যকে কেন্দ্র করে রচিত হয় সেগুলিকে বলে গৌরচন্দ্রিকার পদ।

Read More : বাংলা পেডাগগি । বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর

জীবনী সাহিত্যের সূচনা : চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলিকেই বাংলা সাহিত্যের প্রথম জীবনী সাহিত্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। তাঁর জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়- বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্য ভাগবত’ , কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ , জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ ইত্যাদি কালজয়ী জীবনী গ্রন্থসমূহ।

সাহিত্য ধারায় অভিনবত্ব : চৈতন্যের আবির্ভাবের পরবর্তীকালে সাহিত্যধারাগুলি অহিংসা, মানব প্রেম, উদারতা দ্বারা আপ্লুত হয়ে যায়। মঙ্গলকাব্য , অনুবাদ সাহিত্য , পদাবলি সাহিত্য সর্বত্রই চৈতন্যের অহিংস প্রেমের ভক্তিরস সঞ্চারিত হয়েছিল।

এছাড়াও লোকসাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর শাক্তপদাবলি ও বাউল সংগীতের মধ্যেও যে ভক্তিরসের ধারা প্রবাহিত, তার উৎসেও চৈতন্য-প্রভাবের প্রতিফলন আছে। আসলে চৈতন্য মহাপ্রভুর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন দিক থেকে বাংলা সাহিত্যসৃষ্টির ধারাকে প্রভাবিত ও পরিপুষ্ট করেছেন তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করবেন এ কথা বলাই বাহুল্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Primary TET 2022 Mock Test

X